সাব্বী সাবা...
বাবা শুধু একটি সম্পর্ক নয়, এটি একটি আশ্রয়, এক নির্ভরতার নাম। তিনি সবসময় সামনে থাকেন না, কিন্তু তাঁর ছায়া পড়ে আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তে, প্রতিটি স্বপ্নে। বাবার ভালোবাসা মায়ের মতো প্রকাশ্য নয়, কিন্তু তার গভীরতা অনেক বেশি। সেই ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে প্রত্যেকটি পরিশ্রমের ঘামে, প্রত্যেকটি চিন্তিত চোখের কোণে। আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ি, তখনো তিনি জেগে থাকেন আমাদের ভবিষ্যতের চিন্তায়।
আজ রবিবার, ১৫ জুন ‘বিশ্ব বাবা দিবস’। প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্ববাসী বাবা দিবস হিসেবে এই দিনটিকে বিশেষভাবে পালন করে থাকে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে বাবা দিবস পালনের প্রচলন শুরু হয়। পৃথিবীর সব বাবাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশের ইচ্ছা থেকেই যার যাত্রা শুরু হয়েছিল।
বাবা হচ্ছেন মানবজীবনের সুশীতল ছায়াতলে আগলে রাখা এক মহান ব্যক্তি বা জীবন চলার ক্ষেত্রে ছাতা স্বরুপ আশ্রয়স্থল। একজন মানুষের জীবনের প্রথম ‘সুপার হিরো’ হিসেবে বেশিরভাগ মানুষই নিজের বাবার কথা উল্লেখ করেন।

বাবার কথা বলতে গিয়ে অনেকেই বলেন, বাবা হলেন সেই বটবৃক্ষ, যা রোদ, বৃষ্টি কিংবা ঝড়ে সন্তানকে আগলে রাখে পরম মমতায়। বাবা-মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য আলাদা কোনও দিবসের প্রয়োজন হয় না। তবে বিশেষ একটি দিনে যদি খানিকটা সময় তাদেরকে নিয়ে আনন্দঘন ও উৎসবমুখর পরিবেশে আলাদা করে কিছু স্মৃতিচারণ করে রাখা যায়, তবে তাতে ক্ষতি কী? তবে মা দিবস বাবা দিবস পালন করতে কোনো বিশেষ দিনের প্রয়োজন হয়না। একজন সন্তান তাদের ভালোবাসার মাধ্যমে প্রতিটি দিনকেই বিশেষ দিন হিসেবে গণ্য করে তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারে।
অনেক বছর ধরেই শুধু মা দিবস পালন করার রীতি ছিল কিন্তু হঠাৎ আমেরিকার বিশেষ এক ঘটনার প্রেক্ষিতে বাবা দিবস উদযাপনের বিষয়টি তারা উপলব্ধি করে। তারা উপলব্ধি করল যে, মায়েদের পাশাপাশি বাবারাও যে তাদের সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল এটা বোঝানোর জন্যই এই দিবসটি পালন করা প্রয়োজন। আর তখন থেকেই বাবা দিবস উদযাপনের যাত্রা শুরু হয়।
ঔবিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ দিবসটি ভিন্ন ভিন্ন দিনে পালন করা হয়। বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাবা দিবস পালন করা হয় জুন মাসের তৃতীয় রবিবার। দক্ষিণ আমেরিকায় দিবসটি পালিত হয় ১৯ মার্চ। আর অস্ট্রেলিয়া ও ফিজিতে পালন করা হয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম রবিবার।
বাবার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের এই বিশেষ দিবসে সন্তানরা বাবাদের কোনও না কোনও উপহার দিতে পছন্দ করে। বিশ্বের অনেক দেশে ঘটা করে বাবা দিবস উদযাপন করা হয়। সমাজ, সংস্কৃতি, দেশভেদে উদযাপনে কিছুটা বৈচিত্র্য দেখা যায়। কোনও দেশে হয়তো সন্তান বাবাকে ফুলের তোড়া, কার্ড এবং বিভিন্ন উপহার সামগ্রী দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়, আবার কোনও দেশে নেকটাই, টুপি, মোজা ও বিভিন্ন স্পোর্টস সামগ্রী উপহার দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়।
'প্রবাদে আছে বাঙালি দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝে না'। প্রবাদটি সত্যিই বটে - কারণ আমরা বাবা জীবিত থাকলে তাদের কাছ থেকে পাওয়া আদর, ভালোবাসা, স্নেহ মায়া, মমতা কখনোই মন থেকে উপলব্ধি করতে পারিনা।
শৈশবে বাবা যখন আদর করতেন তখন মনে হতো বাবাই আমার পৃথিবীর সব। আবার অন্যায় করলে যখন শাসন করতেন তখন মনে মনে তার প্রতি অনেক রাগ ও ঘৃণা জন্মাত।
আর আমার ক্ষেত্রেই বলি যেদিন ঘুম থেকে উঠে প্রথম ফোন কলটি রিসিভ করে জানতে পারলাম বাবা নামের বটবৃক্ষের ছায়াটা চিরতরে আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে তখন মনে হয়েছিল আকাশটা যেন আমার মাথার উপর ভেঙ্গে পড়েছে। কোনো ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে মনে ভেবেছিলাম এটা কি করে সম্ভব? বাবাকে ছাড়া কি জীবন পাড়ি দিতে পারবো?
সেদিন অনেক কান্না করেছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম, যে পৃথিবীতে বাবা নেই সেই পৃথিবীতে আমার বেঁচে থাকাটাই যেন অর্থহীন।
দাফন-কাফন শেষে যখন বাবার নিথর দেহটি খাটিয়ায় করে কাঁধে বহন করতে গেলাম সারা শরীর যেন অবশ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। হাঁটতে পারছিলাম না কোনো ক্রমেই, শরীরের সমস্ত শক্তি যেন সেদিন হারিয়ে গিয়েছিল।
এখন বাবা হয়েছি, এখন বুঝতে পাড়ি প্রত্যেক বাবাদের পরিবার ও সন্তানদের প্রতি কতটা দায়িত্ববোধ থাকে। সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাদের কতইনা সংগ্রাম করতে হয়। বাবা না হলে কোনো পুরুষই বাবা নামের জীবন সংগ্রামের এই যোদ্ধাদের ভূমিকা সম্পর্কে জানতেই পারতো না।
সন্তান যখন কোন সফলতা অর্জন করে মনে হয় সফল হয়েছেন বাবা। বাবা তো এমনি। বাবার যে কত গুন আছে তা কখনো বলে কিংবা লিখে ব্যাখ্যা করে শেষ করা যাবে না। আমার মতো সবার বাবা ও সবাইকে এমন করেই মানুষ করে ভালবাসে কিন্তু আজ দুর্ভাগ্য সমাজের অনেক বাবার আশ্রয়স্থল বৃদ্ধাশ্রম। আফসোস ঐ সকল সন্তানদের জন্য।
শৈশবে বাবার সাথে সন্তানের যে সখ্যতা, স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো কি কখনও ভুলে যাওয়া সম্ভব? না,এসব কখনোই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিবছরের ন্যায় এবারেও আজ সারা পৃথিবীতে আনন্দঘন মুহূর্তের সাক্ষী রেখে সবাই বাবা দিবস পালন করবে।
যাদের বাবা জীবিত আছেন তাদের জন্য দিনটি খুব আনন্দময় হবে। আর আমার মতো যাদের বাবা চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন তাদের জন্য দিনটি হবে খুব কষ্টদায়ক ও যন্ত্রণার।
আজকের এই বাবা দিবসে পৃথিবীর সকল জীবিত বাবাদের জানাই অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আর যাদের বাবা পরম যত্নে ও আদর-ভালোবাসা, স্নেহ-মমতায় গড়া কলিজার টুকরো সন্তানদের ছেড়ে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চিরতরে হারিয়ে গেছেন তাঁদের জন্য মন থেকে দোয়া করি আল্লাহ যেন তাঁদের জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। পরিশেষে এটিই বলবো বাবা মায়ের জন্য প্রতিটি সন্তানের যেন মুনাজাতে থাকে "রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বায়নি সাগিরা"।
লেখক: চিকিৎসক ও ব্যবসায়ী
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!