ব্যাংকঋণের মান নির্ধারণে আবারও আন্তর্জাতিক চর্চার পথে হাঁটছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না হলে তা মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে গণ্য হবে এবং ৯০ দিনের মধ্যে অনাদায়ি ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে। আগামী বছরের এপ্রিল মাস থেকে এই নীতিমালা কার্যকর হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুধবার (২৭ নভেম্বর) খেলাপি ঋণসংক্রান্ত সর্বশেষ নীতিমালা প্রকাশ করেছে। দীর্ঘ ১২ বছর পর জারি করা এই নীতিমালার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি কাঠামো তৈরি করার চেষ্টা চলছে।
- খেলাপি ঋণ নিয়ে ব্যাংকারদের শঙ্কা
ব্যাংকারদের মতে, নতুন নিয়ম কার্যকর হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি বাড়তে পারে। এর পাশাপাশি, নিয়মিত ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হবে, যা ব্যাংকের মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, এই নীতিমালার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত সম্পদের মান নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। এটি ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে।
- ঋণখেলাপির চিত্র ও শঙ্কা
বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সরকারি ব্যাংকের তুলনায় বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার বেশি।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে খেলাপি ঋণের নীতিমালা শিথিল করার কারণে অনেক ঋণগ্রহীতা খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ পেতেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে কঠোর নীতিমালা কার্যকরের কারণে এখন ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে।
- নীতিমালায় বড় পরিবর্তন
নতুন নীতিমালায় সব ধরনের ঋণের ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণের সময়সীমা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণকে "নিম্নমান," ছয় থেকে ১২ মাসে "সন্দেহজনক," এবং ১২ মাসের বেশি হলে "মন্দ/ক্ষতিজনক" ঋণ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।
এছাড়া, স্পেশাল মেনশন হিসাবে চিহ্নিত ঋণের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ এবং বিরূপ মানের ঋণের ক্ষেত্রে সঞ্চিতির হার ২০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।
- বিশেষজ্ঞদের মতামত
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেছেন, "এই নীতিমালার মাধ্যমে ব্যাংকঋণের প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসবে। এটি ব্যাংকগুলোকে নিয়ম মেনে ঋণ প্রদানে মনোযোগী করবে। যদিও এটি সাময়িকভাবে ব্যাংকের মুনাফায় প্রভাব ফেলতে পারে।"
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, "নীতিমালা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এ সিদ্ধান্ত ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরে আসার পর এটি কার্যকর করা হলে ভালো হতো।"
- কেন এই পরিবর্তন?
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা করেই নতুন নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে। ব্যাংকগুলোকে আগামী বছরের জুন থেকে নতুন নিয়ম অনুযায়ী ঋণের মানসংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
নতুন নীতিমালার ফলে ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা আসবে বলে আশা করা হলেও, এটি ব্যাংকগুলোর মুনাফা এবং ব্যবসায়িক স্থিতিশীলতায় চাপ তৈরি করতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের ব্যাংকিং খাতকে আরও শক্তিশালী করবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!