এইচ এম আরিফ হোসেন/
চাঁদপুরসহ পাশবর্তী জেলার বাসিন্দাদের চিকিৎসার জন্য একমাত্র ভরসাস্থল হচ্ছে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতাল। আর এই হাসপাতালের সাথে ২০১৮ সালে যোগ হয়েছে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ। এটি স্বাস্থ্যসেবার জন্য সুখবর হলেও এখন পর্যন্ত এই মেডিকেল কলেজটি তার বাস্তব রুপে দাঁড়াতে পারেনি। হাসপাতালের চতুর্থ তলায় কয়েকটি কক্ষ নিয়ে ২০১৯ সালে মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছেন খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। আর চিকিৎসা সেবার মান বৃদ্ধি ও সেবা নিশ্চিত করার জন্য হাসপাতালের জনবল ও শয্যা বৃদ্ধির করার কথা জানালেন তত্ত্বাবধায়ক।
জেলা পর্যায়ে চিকিৎসা সেবার মান বৃদ্ধি ও চিকিৎসক তৈরীর লক্ষে ২০১৮ সালে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের অনুমোদন হয়। এরপর ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে ৫০জন শিক্ষার্থী নিয়ে হাসপাতালের চতুর্থ তলায় মেডিকেল কলেজের যাত্রা। বর্তমানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ৩২৫জন। এর মধ্যে প্রথম থেকে পঞ্চম ব্যাচে ৫০জন করে এবং ৬ষ্ঠ ব্যাচে ৭৫জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। ইতোমধ্যে প্রথম ব্যচ থেকে ৩৮জন চিকিৎসক তাদের কোর্স সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু মেডিকেল কলেজের জমি অধিগ্রহণের স্থান নির্বাচনে জটিলতা দেখা দিলে অবকাঠামগত প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালে শেষের দিকে শহরতলীর ইসলামপুর গাছতলা মৌজার ডাকাতিয়া নদী তীরবর্তী এলাকায় ৩০.১২ একর ভূমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
চলতি বছরের ২৮ জুলাই চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল অবকাঠামো বাস্তবায়নের জন্য একজন পরিচালক ও একজন সহকারী পরিচালক নিয়োগ দেয় সরকার। প্রকল্প পরিচালক হলেন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ এণ্ড হাসপাতালের চিকিৎসক কাজী আবরার হাসান।
চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ও সহকারী প্রকল্প পরিচালক (ডিপিডি) ডাঃ মো. হারুন অর রশিদ বলেন, নানা সমস্যা কাটিয়ে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একনেক বৈঠকে ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের অবকাঠামগত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্প অনুমোদন হয়। এর মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য বরাদ্দ প্রায় ১৫০ কোটি টাকা এবং বাকী টাকায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নার্সিং কলেজ, ছাত্র-ছাত্রী হল, ইন্টার্নি চিকিৎসক হল, ডক্টরস্ কোয়াটার, ডক্টরস ডরমেটরি, স্টাফ কোয়ার্টার, নার্সিং হোস্টেলসহ এই সম্পর্কিত ২৭ ধরণের অবকাঠাম উন্নয়ন বাস্তবায়ন হবে।
চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ এর বর্তমান সংকট নিয়ে উপাধ্যক্ষ ও সহযোগী অধ্যাপক (সার্জারি) ডাঃ মো. হারুন অর রশিদ বলেন, আমাদের কলেজে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারি মিলিয়ে ১০১জন জনবল থাকার কথা। বর্তমানে সব মিলিয়ে আছে ৬০জন। এখনও বিষয়ভিত্তিক ২৩জন শিক্ষক চিকিৎসক ও অন্যান্য পদের ৪১টি পদ শূন্য রয়েছে। শিক্ষক সংকটের কারণে প্রথমত শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষা ব্যহত হচ্ছে। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠার জন্য শিক্ষকরা তাদের নিজস্ব বিষয় ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে অতিরিক্ত পাঠদান করতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের মেডিকেল কলেজের বিশেষজ্ঞ ৫৮জন চিকিৎসক বর্তমানে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে রুটিন করে সব ধরণের সার্জারিসহ চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রেখেছেন। এতে করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে চিকিৎসা বঞ্চিত বহু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উন্নত চিকিৎসার আওতায় এসেছেন। তাদেরকে এখন আর উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্য জেলায় যেতে হয় না। যার ফলে ঢাকাসহ অন্য জেলায় চিকিৎসার জন্য রোগী পাঠানোর হার কমে এসেছে।
মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অন্দ্রিলা দে পুজা, সু-প্রভা, আমিনা আহম্মেদ মুম তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেন, আমাদের নিজস্ব ক্যাম্পাস নেই। শিক্ষক সংকট। আবাসিক হোস্টেলের সমস্যা। অস্থায়ীভাবে হাসপাতালের চিকিৎসক কোয়াটারে থাকতে হচ্ছে, তাও সকলের জন্য সিট বরাদ্দ নেই। এসব সংকটগুলো খুব দ্রুত সমাধান প্রয়োজন।
চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাইদুল ইসলাম বলেন, বর্তমান ক্যাম্পাস থেকে হোস্টেল অনেক দুরে। যাতায়াতে সমস্যা হয়। আমাদের শ্রেণি কক্ষ, শিক্ষক ও লাইব্রেরীর সংকট রয়েছে। এতে আমাদের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে।
চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ সাহেলা নাজনীন বলেন, আমাদের বর্তমান যা আছে তা দিয়ে ভালভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছি। নতুন প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। এসব মেনেই কাজ করতে হয়। ধীরে ধীরে এসব সমস্যা সমাধান হবে।
তিনি বলেন, আমাদের মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা চিকিৎসক হয়ে এই হাসপাতালেই ইন্টান চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন। যে কারণে হাসপাতালে ২৪ ঘন্টা চিকিৎসক থাকছে। আর ৮ ঘন্টা করে তিন ভাগে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
গত কয়েকদিন হাসপাতাল ঘুরে দেখাগেল, নারী, পুরুষ, শিশুসহ প্রত্যেকটি ইউনিটে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। এক সময়ে এই হাসপাতালের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি থাকলেও বর্তমানে পরিবেশে রোগীরা সন্তুষ্ট।
গাইনী ইউনিটে চিকিৎসারত শহরতলীর তরপুরচন্ডী ইউনিয়নের কাশিম বাজার গ্রামের রোগী তানজিলা (২৭) বলেন, গত ৪ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। বড় ধরনের অপারেশন হয়েছে। ভাল চিকিৎসা পেয়ে আমার রোগের উন্নতি হচ্ছে।
একই ইউেিনটর আরেক রোগী পিংকি বেগম (২৫) জানালেন, সিজারিয়ানের মাধ্যমে পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এই হাসপাতালে আগেও চিকিৎসা নিয়েছি। কিন্তু এখন ২৪ঘন্টা চিকিৎসকরা সেবা দিচ্ছেন। যার ফলে আমার সন্তানসহ উভয়ের ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে।
কচুয়া উপজেলার আলিয়ারা গ্রাম থেকে আসা রোগী সোহেল রানা (২৩) বলেন, তিনি ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে এসেছেন। এসেই চিকিৎসক এবং ওষুধ পেয়েছেন। পরীক্ষার জন্য বাহিরে যেতে হয়নি। হাসপাতাল থেকেই সব ব্যবস্থা হয়েছে। কয়েকদিন থেকেই চিকিৎসক ও নার্সদের আন্তরিক সেবা পেয়েছি।
হাইমচর উপজেলার চরকৃষ্ণপুর গ্রামের শহর আলী (৬৫) নামে বৃদ্ধ বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যায় এবং মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত বিক্ষত হয়। ঘটনার পরেই তিনি এই হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালের পক্ষ থেকেই পরীক্ষা নীরীক্ষাসহ যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা যেতে চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছেন।
হাসপাতাল ঘুরে ইন্টান চিকিৎসক রাহী, সাফওয়াত সাইমুন, মিজানুর রহমান রাহাত, মাসুম বিল্লাহ, শামসুন নাহার হেনান, মাহফুজা আফরিন, তাসনিম ফারহা মীম এর সাথে কথা হয়। তারা ওই সময় রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছিলেন। তারা বলেন, গত সেপ্টেম্বর মাসে তারা হাসপাতালে ইন্টান ডাক্তার হিসেবে যোগদান করেছেন। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে তারা ৩৮জন চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন।
চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সেবা বিষয়ে কথা হয় হাসপাতালের প্যাথলজিস্ট আবদুল মালেকের সাথে। তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত সকল প্যাথলজি সেবা আমরা নিয়মিত দিয়ে যাচ্ছি। সরকার থেকে পাওয়া সকল চিকিৎসা সরঞ্জাম সচল আছে। শুধুমাত্র কিছুদিন আগে একটি এ্যানালাইজার মেশিন ত্রুটি দেখা দিলে মেরামতের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে সেটি চলে আসবে। তবে সেবা দিতে গিয়ে জনবল সংকট রয়েছে। এই বিভাগের শূন্য পদগুলো পুরন হলে রোগীদের আরও দ্রুত সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে।
এদিকে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ একেএম মাহবুবুর রহমান বলেন, হাসপাতালের প্রথমত সমস্যা হচ্ছে শয্যা। ২৫০ শয্যার হাসপাতালে নিয়মিত ৪০০ থেকে ৫০০জন রোগী ভর্তি থাকে। তাদেরকে বেড দিতে না পারায় অনেক রোগী হাসপাতালের মেঝেতে ও বারান্দায় থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। এতে আমাদেরও রোগীদের তত্ত্বাবধান করতে সমস্যা হয়। এই হাসপাতালে শুধুমাত্র চাঁদপুর জেলাই নয়, যোগাযোগ উন্নত হওয়ার কারণে পাশের শরীয়তপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলার বহু রোগী এখানে এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
জনবল সংকট বিষয়ে তিনি বলেন, হাসাপাতালে ৬৮টি পদ রয়েছে। বর্তমানে ৪৮জন থাকলেও শূন্য পদ রয়েছে ২০টি। দ্বিতীয় শ্রেণীর নার্স ১৫৮ জনের মধ্যে আছে ১১৮জন। বর্তমানে শূন্য পদ রয়েছে ৪০টি। তৃতীয় শ্রেণীর ৫৯ জনের মধ্যে রয়েছে ৪১জন। এই পদে শূন্য ১৮জন। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারির মধ্যে ১১০জনের বিপরীতে আছে ৬৮জন।
তত্ত্বাবধায়ক বলেন, জেলা সদর হাসপাতাল হিসেবে ৪টি আইসিইউ বেড, ১৬টি সিসিইউ বেড, ৮টি এনআইসিও বেড আছে। এসব বিশেসায়িত সেবার জন্য আরো বেড বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। হাসপাতালের জমির সংকটের কারণে ভবন নির্মাণ হয়নি। জানতে পেরেছি আমি এখানে আসার পূর্বেই ভবনের জন্য ১৬ কোটি বরাদ্দ এসেও ফেরত যায়। হাসপাতালের এমন পরিস্থিেিত দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি নতুন ভবন নির্মান করা জরুরি মনে করছি।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!