ইউক্রেন বর্তমানে তার তরুণ প্রজন্মকে যুদ্ধে নামানোর জন্য পশ্চিমা মিত্রদের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে রয়েছে। দেশটির সরকার ২০২৩ সালের এপ্রিলে নতুন একটি মোবিলাইজেশন আইন পাস করেছিল। তবে সেই আইনের মাধ্যমে প্রত্যাশিত সদস্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি এইচআইভি ও যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সেনাবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা সত্ত্বেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।
তরুণদের যুদ্ধে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হওয়ার পর কিছু পশ্চিমাপন্থী ইউক্রেনীয় কর্মকর্তা সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য বয়সসীমা আরও কমানোর প্রস্তাব করেছেন। তবে জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ এবং অনীহা প্রেসিডেন্টের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিন বছরের এই দীর্ঘ যুদ্ধ ইউক্রেনের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবকাঠামোর দুর্বলতাকে আরও প্রকট করে তুলেছে।
ক্লান্ত জনগণ ও দুর্বল সামাজিক চুক্তি
ইউক্রেনের জনগণ এখন শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্লান্ত। তবে এই ক্লান্তি শুধুমাত্র যুদ্ধের নয়, বরং দেশের ভঙ্গুর সামাজিক চুক্তির কারণেও। সোভিয়েত-পরবর্তী যুগে ইউক্রেনে এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে রাষ্ট্র নাগরিকদের জীবনে বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখবে না। এই ধারণার সঙ্গে যুদ্ধকালীন সময়ে রাষ্ট্রের আচরণের পার্থক্য জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে।
যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে ইউক্রেনের জনগণের মধ্যে একতা দেখা গেলেও যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। সমাজের একটি অংশ যুদ্ধের বোঝা বহন করছে, যেখানে অন্য একটি অংশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন করছে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকার জানায় যে ২০২৫ সালে মুদ্রাস্ফীতি ১২ শতাংশে পৌঁছালেও ন্যূনতম মজুরি ও সামাজিক ভাতা বাড়ানো হবে না। এর ফলে জনগণের একটি বড় অংশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি দেখা দিয়েছে।
যুদ্ধের জন্য সদস্য সংগ্রহে চ্যালেঞ্জ
+
১৭ জুলাইয়ের মধ্যে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার যোগ্য সব পুরুষকে তথ্য জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে মাত্র ৪০ লাখ পুরুষ তথ্য জমা দেন, যেখানে ৬০ লাখ পুরুষ এটি করেননি। ইতোমধ্যে ৫ লাখ পুরুষের বিরুদ্ধে তথ্য না দেওয়ার অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়েছে।
এ ধরনের পদক্ষেপ জনগণের মধ্যে যুদ্ধের প্রতি অনীহা এবং রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা কমানোর প্রমাণ। এক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৩২ শতাংশ নতুন যুদ্ধ আইনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, যেখানে ৫২ শতাংশ বিরোধিতা করেছেন।
বৈষম্যপূর্ণ পরিস্থিতি ও দুর্নীতি
যুদ্ধে যোগ দেওয়া থেকে ছাড় পাওয়ার জন্য অনেকেই ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সামরিক বাহিনীতে যোগদানের জন্য কর্মকর্তাদের বড় অঙ্কের ঘুষ দেওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। গত এক বছরে ৬০ লাখ ডলার ঘুষ উদ্ধার করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
অনেক ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন। রোমানিয়া এবং হাঙ্গেরির সীমান্তে টাইসা নদী পাড়ি দেওয়ার সময় ৪৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
গভীর বিভক্তি ও মনোবলের অভাব
যাদের যুদ্ধে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে, তারা সাধারণত দরিদ্র গ্রামীণ মানুষ। তারা ঘুষ দেওয়ার সামর্থ্য না থাকার কারণে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন। এই গোষ্ঠীর মনোবল অত্যন্ত নিম্ন। সামরিক বাহিনীর মধ্যে অনেক সময় মারধরের মতো ঘটনাও ঘটছে, যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করছে।
অন্যদিকে, কিয়েভ ও লভিভের মতো শহরের এলিট গোষ্ঠী তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ও আরামদায়ক জীবন যাপন করছে। তারা দেশপ্রেমের কথা বলে সবাইকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করলেও নিজেরা এই দায়িত্ব থেকে দূরে থাকছেন।
যুদ্ধের ভবিষ্যৎ ও জাতীয় সংকট
ইউক্রেনের যুদ্ধ শুধু রাশিয়ার শক্তির কারণে দীর্ঘায়িত হচ্ছে না। বরং দেশের অভ্যন্তরীণ বিভাজন, দুর্নীতি এবং সামাজিক অবকাঠামোর ভঙ্গুরতাও বড় কারণ।
যে জাতি স্বাধীনতার পর থেকে নিজেদের সামাজিক চুক্তিকে কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেই জাতি আজ তাদের জনগণকে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করতেও অক্ষম। বিভক্ত জাতি ও দুর্বল নেতৃত্বের কারণে ইউক্রেনের জনগণ ধীরে ধীরে আলোচনার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
যুদ্ধ ইউক্রেনের জনগণের জন্য একটি বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কেবল বাহ্যিক শক্তি নয়, জাতীয় ঐক্য এবং নেতৃত্বের প্রয়োজন। তা না হলে দেশটির যুদ্ধের ফলাফল প্রতিদিন আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!