দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পূর্ব প্রুশিয়ার অরণ্যে ‘ভল্ফশাঞ্জে’ নামের গোপন বাংকারে কাটানো অ্যাডলফ হিটলারের তিন বছরের জীবন এবং মানসিক অবনতির চিত্র তুলে এনেছেন ইতিহাসবিদ ফেলিক্স বোয়ের। তাঁর গবেষণাধর্মী বইয়ে উঠে এসেছে ষড়যন্ত্র, যুদ্ধব্যর্থতা এবং একনায়কতান্ত্রিক মানসিক সংকটের বিস্তারিত খতিয়ান।
মানবীয় ভাষায় পুনর্লিখন:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্ধকারতম একটি অধ্যায় ছিল হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি জার্মানির উত্থান ও করুণ পতন। কিন্তু ইতিহাসের এই ভয়াবহ কাহিনির মাঝে এক রহস্যময় অধ্যায় অনেকটাই অজানাই থেকে গেছে—পূর্ব প্রুশিয়ার গভীর অরণ্যে অবস্থিত হিটলারের গোপন সামরিক ঘাঁটি ‘ভল্ফশাঞ্জে’ বা ‘নেকড়েদের আস্তানা’। এখানে, পুরো তিন বছর—১৯৪১ থেকে ১৯৪৪—প্রায় ৮০০ দিনের বেশি সময় কাটিয়েছেন হিটলার, বিচ্ছিন্নভাবে, যন্ত্রণায়, ষড়যন্ত্র আর আত্মবিশ্বাসহীনতায় জর্জরিত হয়ে।
জার্মান ইতিহাসবিদ ও সাংবাদিক ফেলিক্স বোয়েরের লেখা সাম্প্রতিক বই ‘পতনের পূর্বে ভল্ফশাঞ্জে হিটলারের বছরগুলো’ এই অজানা সময়ের দরজায় আলো ফেলেছে। বইটিতে উঠে এসেছে হিটলারের দৈনন্দিন জীবন, মানসিক অবস্থা, অপ্রতিরোধ্য নেতার ভেতর জমতে থাকা সন্দেহ, রোগ ও ব্যর্থতার গ্লানি।
শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আশাবাদী ছিলেন হিটলার। ২২ জুন ১৯৪১-এ ‘অপারেশন বারবারোসা’ চালিয়ে রাশিয়ার মাটি দখল করতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন কয়েক সপ্তাহেই মস্কো জয় করবেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ গড়িয়ে যায় হতাশার দিকে। পরিকল্পিত কয়েক সপ্তাহ পরিণত হয় তিন বছরের দীর্ঘ নির্বাসনে। আর এই সময়েই ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকেন স্বঘোষিত ফুহরার।
ভল্ফশাঞ্জে বসেই হিটলার নিয়ন্ত্রণ করেছেন পুরো যুদ্ধ। অথচ বাংকারটি ছিল ঘোর অন্ধকারে ঢাকা এক মানসিক ‘কারাগার’। এখানে প্রতিদিন তাঁকে ঘিরে থাকত সীমিত কয়েকজন কর্মকর্তা। বাইরের নতুন মুখ তাঁর অপছন্দ ছিল। ঘনিষ্ঠদের সঙ্গেও কথোপকথন হত ক্লান্তিকর ও গতানুগতিক। যুদ্ধের জটিলতা, অবরুদ্ধ সেনাবাহিনী আর স্টালিনগ্রাদের বিপর্যয় তাঁকে আরো বিচ্ছিন্ন করে তোলে।
তাঁর শারীরিক অবস্থাও ক্রমে খারাপ হতে থাকে—হাত-পা কাঁপা, জন্ডিস, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, কোকেন ইনজেকশনে ভরসা। টাইমবোমা হামলার পর ষড়যন্ত্রভীতিতে আক্রান্ত হন। জীবনের শেষ দিকে তাঁর নিজের কুকুর ব্লন্ডিকেও আর ঘুরতে নিয়ে যেতেন না। শেষদিকে একমাত্র ট্রাউডল ইউঙ্গের বক্তব্যেই ধরা পড়ে সেই দৃষ্টিহীনতা—‘হিটলার তখন আর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন না, শুধু বাঁচার চেষ্টা করছিলেন।’
১৯৪৪ সালের নভেম্বরে ভল্ফশাঞ্জে ছেড়ে তিনি চলে যান বার্লিনের চূড়ান্ত গোপন বাংকারে, যেখানে তাঁর জীবনাবসান ঘটে ১৯৪৫ সালে। অথচ ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সিদ্ধান্তগুলোর অনেকটাই নেওয়া হয়েছিল এই বনবেষ্টিত, মশাবেষ্টিত, দুঃস্বপ্নের বাংকারে বসেই।
ফেলিক্স বোয়েরের বইটি শুধু ইতিহাসের দলিল নয়, এক স্বৈরাচারীর মানসিক ভাঙনের বাস্তব ছবি। ‘নেকড়েদের আস্তানা’ তাই শুধু একটি গোপন সামরিক ঘাঁটি নয়—এটি একনায়কতন্ত্রের আত্মধ্বংসের এক নিঃসঙ্গ মঞ্চ।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!