এইচ এম আরিফ হোসেন//
চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলার দক্ষিণের শেষ প্রান্তে চরভৈরবী ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নেই নদীর তীরবর্তী নীল কমল নৌ পুলিশ ফাঁড়ি অবস্থিত। নীল কমল নৌ পুলিশ ফাঁড়ির নাকের ডগায় চরভৈরবী লঞ্চঘাট সংলগ্ন অবস্থিত চাঁদপুর জেলার অন্যতম এই পাইকারী মাছ ক্রয় বিক্রয়ের স্থান চরভৈরবী মৎস আড়ৎ। মেঘা নদী থেকে ধরা ঝাকে ঝাকে ইলিশ সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ লক্ষ লক্ষ টাকায় ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে ভোর থেকে সন্ধা পর্যন্ত এই আড়ৎগুলোতে। চরভৈরবী মাছ ঘাটের আড়ৎ গুলোতে ভোর থেকে সন্ধা পর্যন্ত জমজমাট থাকে জাটকা ইলিশ ক্রয়-বিক্রয়ে। অতচয় নৌ পুলিশের নাকের ডগায়, তাদের নদীতে উঠা নামা করার এক মাত্র রাস্তার সাথেই এই পাইকারী বাজারে মাছ গুলো বিক্রি হচ্ছে। নির্বিচারে মেঘনা নদী থেকে জেলেদের ধারা জাটকা নিধন হলেও নৌ পুলিশের কোন ভূমিকা নেই। প্রতিদিন শতে শতে নৌকা ঘাটে ভিড়ে বস্তা বোঝাই করা জটকা মাছ আড়ৎদে বিক্রি করে যাচ্ছে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে নৌ পুলিশ সহ প্রশাসন চুপ।
জানা যায় চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলার সর্ব-দক্ষিণে চর ভৈরবী ইউনিয়নের অবস্থান। এ ইউনিয়নের উত্তর-পূর্বে আলগী দুর্গাপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন, উত্তরে নীলকমল ইউনিয়ন, পশ্চিমে হাইমচর ইউনিয়ন, দক্ষিণ-পশ্চিমে বরিশাল জেলার হিজলা উপজেলার হিজলা গৌরাব্দি ইউনিয়ন এবং পূর্বে লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার উত্তর চর আবাবিল ইউনিয়ন অবস্থিত। পশ্চিমে অবস্থিত চরভৈরবীর বুক ছিড়ে বয়ে যাওয়া সর্ববৃহত ঐতিহাসিক মেঘনা নদী। এই ইউনিয়নের মোট আয়তন ২,৫৬৯ একর। পরুষ ও মহিলা সহ মোট জনসংখ্যা ২৮১০০ জন। ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চর ভৈরবী ইউনিয়নের সাক্ষরতার হার ৬৪.৫%। অধিকাংশের পেশা কৃষি ও মৎস শিকার।
চরভৈরবী ইউনিয়নের প্রধান হাট-বাজার গুলো হলো চরভৈরবী লঞ্চঘাট বাজার, গরম বাজার, আমতলী বাজার ইত্যাদি, চরভৈরবী নতুন বাজার।
চরভৈরবী মৎস আড়ৎ গুলো সরজমিনে ঘুরে দেখা যায় ভোর বেলা থেকে সন্ধা পর্যন্ত মাছ বিক্রির ধুম।জেলেরা রাত ভর মাছ শিকার করে ভোর থেকে জেলেদের দাদন দেয়া আড়ৎ গুলোতে মাছ নিয়ে আসে। আড়ৎদার ডাকের মাধ্যমে পাইকারী ক্রেতাদের নিকট মাছ বিক্রি করে। আড়ৎদারা বিক্রি করা মাছের টাকা থেকে জেলেদের প্রকারভেদ অনুযায়ী শতকরা ৩% থেকে ১০% লাভাংশ নেন। গড়ে আড়ৎদারা ৮% লাভাংশ জেলেদের নিকট থেকে নিয়ে যাচ্ছে। খুচরা ক্রেতারা খাওয়ার জন্য মাছ কিনতে আাসলে পাইকারী ক্রেতারা ডাকের মাধ্যমে মাছের দাম বাড়ি দেয়।এতে করে খুচরা ক্রেতারা বেশি দাম দিয়ে মাছ কিনতে হয়। আড়ৎদারা এ ক্ষেত্রে অধিক লাভবান হয়। লাভবানের দিক দিয়ে ফারুক হাওলাদারের আড়ৎ এগিয়ে। ফারুক হাওলাদার এর আড়ৎ সহ সকল আড়ৎ গুলোতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিপুল পরিমাণে ১০ ইঞ্চি বা ২৫ সেন্টিমিটার থেকে ছোট ছোট জাটকা বিক্রি হচ্ছে।সাইজ অনুযায়ী প্রতি হালি জাটকা ১৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি হচ্ছে।
দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে আট মাস জাটকা ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা না মেনে মেঘনায় অবাধে জাটকা নিধন চলছে। আর এসব জাটকা চরভৈরবী মৎস আড়ৎ গুলোতে বিক্রি হচ্ছে। জেলা প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ ও পুলিশ কঠোর উদ্যোগ না নেওয়ায় জাটকা নিধন বন্ধ হচ্ছে না। এতে ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মৎস্য অধিদপ্তর চাঁদপুর থেকে জানা যায় ২০০৩ সালের মৎস্য সংরক্ষণ আইনের আওতায় প্রতিবছরের ১ নভেম্বর থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৭ মাস জাটকা ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ইলিশের প্রজনন মৌসুমে হেরফের হওয়ায় সরকার ২০১৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে সময়সীমা আরও এক মাস বাড়িয়ে ৩০ জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করে।
মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন ১৯৫০ সালের অনুযায়ী, নিষেধাজ্ঞাকালে জাটকা ধরা, সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিপণন দণ্ডনীয় অপরাধ। আইন অনুযায়ী ১০ ইঞ্চি বা ২৫ সেন্টিমিটার আকৃতির ইলিশ জাটকা হিসেবে গণ্য হবে। এই আইন অমান্য করা হলে ন্যূনতম এক বছর থেকে দুই বছরের জেল অথবা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। এ সময় যাঁরা জাটকা আহরণ, বিপণন, পরিবহন করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা হবে। এ আইন বাস্তবায়নে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ, জেলা প্রশাসন ও মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সম্পৃক্ত থাকবেন।
জাটকা নিধন, বিপণন ও বিক্রিতে এ রকম কঠোর নির্দেশ থাকলেও চরভৈরবীতে জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে জাটকা শিকার ও বিক্রি করছেন।
অথচ ওই বাজার থেকে নীল কমল নৌ পুলিশ ফাঁড়ির দূরত্ব মাত্র ১০০ গজ। কিন্তু জাটকা বিক্রি বন্ধে ওই ফাঁড়ির পুলিশ কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
চাঁদপুর নৌ পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন বিষয়টি যেহেতু জেনেছি আমাদের পক্ষ থেকে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করতে আমরা সব সময় প্রস্তুত।
নীল কমল নৌ পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত ইনচার্জ আরিফুজ্জামান বলেন জাটকা ইলিশের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। আজও ৪০ কেজি জাটকা সহ ১ জেলেকে আটক করেছি। দ্রুত আমরা চরভৈরবী মৎস আড়ৎদে একটি যৌথ অভিযান পরিচালনা করবো।
স্থানীয় কয়েকজন জেলে বলেন, মৎস্যজীবীদের সঙ্গে নীল কমল নৌ পুলিশের বিশেষ সখ্য রয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগসূত্রে মাসোহারার বিনিময়ে জেলেরা প্রকাশ্যে নির্বিচারে দিনে ও রাতের বেলায় কারেন্ট জাল ব্যবহার করে জাটকা মাছ শিকার করছেন। দেড় শতাধিক নৌকায় প্রতিদিন মাছ ধরছে। মৎস্যজীবী সমিতির নেতারাও এই অপতৎপরতার সঙ্গে জড়িত। এতে আগামী দিনে ইলিশের উৎপাদনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চরভৈরবী মৎস আড়ৎ এর সভাপতি চরভৈরবী ১ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ডি এম মমিন বলেন আগে থেকে এখন ব্যবসার অবস্থা খারাপ। আর নদীতে এখন ধরা পড়েই জটকা মাছ। আড়ৎরা টুক টাক বিক্রি করে কোনমতে আড়ৎ চালিয়ে রেখেছে। তারপরও এখানে জাটকা বিক্রি না করার জন্য নিষেধ করে রেখেছি।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!