বাংলাদেশে বন্য হাতির করুণ পরিণতি যেন থামছেই না। গত ৯ বছরে প্রাণ হারিয়েছে ১৪৬টি হাতি, অথচ এই হত্যা ঠেকাতে বন বিভাগের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। বন আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়সারা জিডি করেই দায়িত্ব শেষ করছে তারা।
বন বিভাগের তথ্য বলছে, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মারা গেছে ১১৪টি হাতি, কিন্তু মামলা হয়েছে মাত্র ১৯টি।
অন্যদিকে নেত্রকোনা, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও জামালপুরে ৩২টি হাতি মারা গেলেও মামলা হয়েছে মাত্র ২টি। অধিকাংশ ঘটনায় থানায় শুধু সাধারণ ডায়েরি করেই দায় সারছে কর্তৃপক্ষ।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর অভিযোগ, অনেক সময় ময়নাতদন্তে ইচ্ছাকৃতভাবে সত্য গোপন করা হয়। হাতিকে গুলি করে মারা হলেও বার্ধক্য কিংবা অসুস্থতা কারণ দেখিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়।
শেরপুরে বন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বনের জমি দখল করে চাষাবাদ ও বাগান রক্ষার জন্যই স্থানীয়রা বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে হাতি হত্যা করে। বন বিভাগের হিসাবে, শুধু এই অঞ্চলেই গত ৯ বছরে ২৬টি হাতিকে বিদ্যুতের ফাঁদে হত্যা করা হয়েছে। অন্যদিকে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মারা গেছে ১৮টি, গুলিতে ৭টি এবং অজ্ঞাত কারণে মারা গেছে ১০টি।
পাশাপাশি কক্সবাজারে সংবাদপত্র বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৮টি হাতি গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, যা বন বিভাগের দেওয়া সংখ্যার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আইন আছে, প্রয়োগ নেই
২০১২ সালের বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে বলা হয়েছে, হাতি হত্যার ঘটনায় বন বিভাগ সরাসরি বন আদালতে মামলা করতে পারবে এবং অপরাধ প্রমাণ হলে ২ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে। পুনরায় অপরাধ করলে এই সাজা ১২ বছর পর্যন্ত বাড়তে পারে। অথচ মাঠ পর্যায়ে আইন প্রয়োগে অনীহা রয়েছে।
একাধিক শীর্ষ বন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হওয়ায় অনেক সময় মামলা না করে তারা জিডি করেই দায় শেষ করেন। আবার যদি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি খালাস পান, তবে মামলাদাতাকেই জবাবদিহি করতে হয়। এই আইনি ঝুঁকিও কর্মকর্তাদের মামলা না করার একটি বড় কারণ।
বাস্তব চিত্র: মামলা নয়, শুধু গ্রেপ্তার
২০২৪ সালের ২১ মার্চ শেরপুরে বিদ্যুতের ফাঁদে একটি হাতি মারা যায়। আসামির নাম-ঠিকানা জানা থাকলেও বন বিভাগ বন আদালতে না গিয়ে থানায় মামলা করেছে। পুলিশ জানায়, আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বন কর্মকর্তারা বলছেন, আদালতের ধীরগতির কারণে তারা থানার মাধ্যমে সহজ প্রক্রিয়ায় মামলা নিষ্পত্তি করতে চান।
মানুষ বন দখল করলে মারা পড়ে হাতি
পরিবেশবিজ্ঞানী অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার জানান, হাতির প্রাকৃতিক চলাচলের পথগুলো এখন মানুষের দখলে। করিডরগুলোতে গড়ে উঠেছে বসতি, ধানখেত ও রাস্তা। ফলে হাতিকে উপদ্রব হিসেবে দেখে অনেকে বিদ্যুৎ ফাঁদ পেতে হত্যা করে।
আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় প্রতিবছর নির্বিচারে হাতি হত্যার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের বনাঞ্চলে। এখন সময় এসেছে বন বিভাগের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার এবং আইন প্রয়োগে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!