স্টাফ রিপোর্টার | কক্সবাজার ও বান্দরবান থেকে
ডান পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে নিচের অংশ নেই। ক্ষতবিক্ষত পায়ের বাকি অংশ ব্যান্ডেজে মোড়ানো। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অশ্রুসজল চোখে মোহাম্মদ ফিরোজ বলছিলেন, “আমি গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু আমার পা নেই।”
গত ৬ এপ্রিল মাছ ধরে ফেরার পথে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে একটি এলাকায় মাইন বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হন ফিরোজ। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের আমতলী গ্রামের এই জেলে এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
তাঁর মতো আরও অনেকেই সীমান্তের কাছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পাতা মাইন ও আইইডি বিস্ফোরণের শিকার হয়েছেন। কেউ হারিয়েছেন পা, কেউ সন্তান—আবার কেউ পুরো ভবিষ্যৎ।
ফিরোজের গল্প: জাল কাঁধে, পা উড়ে গেল
ফিরোজ বললেন, “নাফ নদী পার হয়ে লালচর এলাকায় মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে হঠাৎ বিকট বিস্ফোরণ। চোখের সামনে অন্ধকার। হুঁশ ফিরতেই দেখি, আমার পা নেই, কিন্তু কাঁধে এখনো মাছের জাল।”
জালে ধরা ছিল প্রায় সাত কেজি মাছ। ফিরোজ সেই মাছের খালুই আঁকড়ে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে যান। তাঁর চিৎকার শুনে সঙ্গীরা তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
২০ বছরের বেশি সময় ধরে মাছ ধরে সংসার চালাতেন ফিরোজ। বর্তমানে তাঁর চার ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চলে সম্পূর্ণ তাঁর আয়ে। এখন চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন, “চিকিৎসা শেষ হলেও আমি তো আর আগের মতো কাজ করতে পারব না। সংসার কীভাবে চলবে?”
রাবেয়ার কষ্ট: স্বামীর খোঁজ নেই, ছেলেটা নেই
রাবেয়া খাতুনের (৪৫) স্বামী ১৫ বছর আগে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন। এর মধ্যেই গত বছরের ৭ জুলাই মাইন বিস্ফোরণে প্রাণ হারায় তাঁর ছেলে মো. জোবায়ের (১৮)। কাঁকড়া ধরতে গিয়ে নাফ নদীর লালদিয়ার চরে বিস্ফোরণের শিকার হয় সে।
রাবেয়া বলেন, “আমি তখন হাসপাতালে। ছেলেটা জিজ্ঞেস করেছিল—‘মা কই?’—তারপরই মারা যায়। আমার জীবনটাই যেন থেমে গেছে।”
রাবেয়ার ছোট মেয়ে মানুষের বাড়িতে কাজ করে। তিনিও কাজ পেলে করেন। থাকার জায়গাটিও ভাড়া, এক মাসে ৫০০ টাকা দিতে হয়।
সালামের শোকরিয়া: প্রাণে বেঁচেছি, সেটাই অনেক
৩৭ বছর বয়সী আবদুস সালাম নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে পা হারিয়েছেন। চাষাবাদের কাজ করতেন তিনি। নিজের কলাবাগান, পানের বরজ তদারকিতে গিয়েই বিস্ফোরণের মুখে পড়েন।
“বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ নেই। ঘরে পাঁচটি সন্তান। কে দেখবে এখন খেতখামার?”—বললেও তাঁর কণ্ঠে ক্ষোভ নেই, বরং কৃতজ্ঞতা—“প্রাণে বেঁচে গেছি, শোকরিয়া।”
সীমান্তে মৃত্যু ফাঁদ: বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ১ মে পর্যন্ত মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় মাইন ও আইইডি বিস্ফোরণে অন্তত ১৩ জন আহত হয়েছেন। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে প্রাণ হারান এক তরুণ। সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির চলমান সংঘাতের অংশ হিসেবে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে ব্যাপকভাবে মাইন পুঁতে রাখা হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সীমান্ত এলাকার নিরীহ সাধারণ মানুষ।
আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন বলছে, মিয়ানমার শীর্ষে
আইসিবিএল-এর ‘ল্যান্ডমাইন মনিটর ২০২৪’ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে মিয়ানমারে ভূমিমাইন ও বিস্ফোরক বিস্ফোরণে হতাহত হয়েছেন ১,০০৩ জন। এ সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘ চুক্তি অনুযায়ী মাইন নিষিদ্ধ হলেও মিয়ানমার এখনো তাতে সই করেনি।
অসহায় মানুষের প্রশ্ন: কে নেবে দায়?
মোহাম্মদ ফিরোজ, রাবেয়া খাতুন কিংবা আবদুস সালামের মতো অসংখ্য মানুষ আজ জীবনের সবকিছু হারিয়ে রাষ্ট্রের দিকে চেয়ে আছেন। সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়ানো, জরুরি সহায়তা, চিকিৎসা সহায়তা ও ক্ষতিপূরণ—এসব দাবি বারবার তুললেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
প্রশ্ন উঠছে—এই সীমান্তজুড়ে জীবন নিয়ে চলা এ রকম ‘জুয়া’র দায় নেবে কে?
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!