সুখময় দাম্পত্য জীবন প্রতিটি মানুষের কাম্য। ভালোবাসা, পারস্পরিক সমঝোতা এবং একে অপরকে বোঝার মধ্য দিয়ে সংসার হয় জান্নাতের টুকরো। কিন্তু মনোমালিন্য এবং অব্যাহত ঝগড়া সংসারকে রূপান্তরিত করে দুর্বিষহ যন্ত্রণায়। ইসলামে তালাক একটি বৈধ ব্যবস্থা হলেও এটি মহান আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় বিষয়। তাই প্রয়োজন ছাড়া সংসার ভাঙার কোনো নির্দেশনা ইসলাম দেয়নি। বরং সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরও মীমাংসা না হলে ইসলাম তালাকের অনুমতি দিয়েছে।
তালাকের সংজ্ঞা ও ইসলামি পরিভাষা
‘তালাক’ শব্দটি আরবি। এর অর্থ হলো ত্যাগ করা, মুক্ত করা, বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করা। ইসলামি পরিভাষায় বিশেষ শব্দ বা বাক্যের মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করাকেই তালাক বলা হয়। তবে তালাক একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এবং তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা উত্তেজনা বা ক্ষোভের বসে নেওয়া উচিত নয়।
তালাকের পূর্বে করণীয়
তালাকের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে ইসলাম কিছু করণীয় নির্দেশনা দিয়েছে। সেগুলো হলো:
প্রথম করণীয়: স্ত্রীর কোনো আচরণে ক্ষুব্ধ হলেও স্বামীকে সংযত থাকতে হবে। উত্তেজিত না হয়ে মিষ্টি ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ও স্নেহ প্রদর্শনের মাধ্যমে তার মন গলানোর চেষ্টা করতে হবে। ভুল ধারণা থাকলে যুক্তি দিয়ে তা দূর করতে হবে। সবকিছু ধৈর্যের সঙ্গে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা প্রয়োজন।
দ্বিতীয় করণীয়: প্রথম পদক্ষেপে সফল না হলে স্বামী স্ত্রীর প্রতি অভিমান বা মনোভাব প্রকাশের জন্য একসঙ্গে রাতযাপন থেকে বিরত থাকবেন। স্ত্রীর ঘুমানোর স্থান পৃথক করে দেবেন, যাতে স্ত্রী নিজের ভুল বুঝতে পারে। এতে যদি স্ত্রী সতর্ক হয়ে যায়, তবে দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরায় সুন্দর হবে।
তৃতীয় করণীয়: উপরোক্ত দুই পদ্ধতিতে সমাধান না এলে তৃতীয় ধাপে উভয় পরিবারের পক্ষ থেকে সালিশের ব্যবস্থা করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ সৃষ্টির আশঙ্কা করো, তবে পুরুষের পরিবার থেকে একজন সালিশ ও নারীর পরিবার থেকে একজন সালিশ পাঠিয়ে দেবে। তারা মীমাংসা করতে চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করে দেবেন।” (সূরা নিসা: ৩৫)
তালাক: সর্বশেষ বিকল্প
তালাক হলো একেবারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। ইসলামিক শরিয়তে তখনই তালাকের অনুমতি দেওয়া হয়েছে যখন মীমাংসার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, “আল্লাহর কাছে বৈধ কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণিত হলো তালাক।” (আবু দাউদ ২১৭৮) তাই খুব ভেবে-চিন্তে ঠাণ্ডা মাথায় এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তালাকের সঠিক পদ্ধতি
১. স্ত্রী যখন হায়েজ (মাসিক ঋতুস্রাব) থেকে পবিত্র হবেন, তখন স্বামী তার সঙ্গে সহবাস না করে সুস্পষ্ট শব্দে এক তালাক দেবেন। হায়েজ অবস্থায় তালাক নিষিদ্ধ, যাতে তৎক্ষণাৎ উত্তেজনায় নেওয়া সিদ্ধান্ত না হয়। ২. স্বামী সুস্পষ্টভাবে এক তালাক দেবেন। এরপর ইদ্দত (তিন ঋতুস্রাব বা তিন মাস) চলাকালে স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারেন। এতে তাদের সম্পর্ক পুনরায় কায়েম হবে। ইদ্দতের সময় যদি স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে না নেন, তাহলে সম্পর্ক চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ৩. ইসলাম একসঙ্গে তিন তালাক দিতে নিষেধ করেছে। বরং ধীরে ধীরে, তিন পবিত্র সময়ে একটি করে তালাক দিতে বলা হয়েছে। এতে সম্পর্ক পুনরায় ফিরে আসার সুযোগ থাকে এবং সবকিছু চিন্তা-ভাবনার সময় পাওয়া যায়। একসঙ্গে তিন তালাক দিলে এ সুযোগ আর থাকে না।
নারীর তালাক চাওয়ার অধিকার
ইসলাম নারীদের তালাকের ক্ষমতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেয়নি, তবে কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে তা গ্রহণের বিধান রেখেছে। যেমন:
- বিবাহের আগে স্বামীকে শর্ত দিয়ে তালাকের ক্ষমতা নেওয়া।
- স্বামীর কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে তালাক চাওয়া।
- কোনো বড় সমস্যা দেখা দিলে বা স্বামী নপুংসক, পাগল বা নিখোঁজ হলে বিচারকের মাধ্যমে তালাক নেওয়া।
তালাকের সাক্ষী ও গর্ভাবস্থার মাসআলা
তালাকের জন্য সাক্ষীর উপস্থিতি জরুরি নয়। যদি একা বসে তালাকও দেওয়া হয়, তা কার্যকর হবে। গর্ভাবস্থায়ও তালাক কার্যকর হয়। তাই এ বিষয়ে ভুল ধারণা পোষণ করা ঠিক নয়।
তালাক অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। তাই সঠিক মাসআলা শেখা এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া অপরিহার্য। অজ্ঞতার কারণে কোনো হারাম কাজ হালাল হয়ে যায় না।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!