ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধবিরতি থাকলেও, থেমে নেই উত্তেজনা। এবার মুখোমুখি লড়াইয়ের ময়দানে নামছে ড্রোন—নতুন যুগের নতুন অস্ত্র। কাশ্মীর সীমান্তে একের পর এক ড্রোন হামলা ও প্রতিরোধে যেন ফের জেগে উঠেছে দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশীর সামরিক উত্তাপ।
গত ৮ মে জম্মুর আকাশে পাকিস্তান থেকে আসা ড্রোন লক্ষ্য করে গুলি চালায় ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী। এরপর চার দিন ধরে চলা পাল্টাপাল্টি আক্রমণ থামে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতিতে। কিন্তু এই বিরতির ফাঁকেই শুরু হয় এক নতুন প্রতিযোগিতা—কে কতো আধুনিক ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সামরিকভাবে এগিয়ে যাবে, তাই নিয়ে এখন টানটান লড়াই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এবারই প্রথম ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে এত ব্যাপকভাবে ড্রোন ব্যবহার করেছে।
ড্রোনে বিশাল বিনিয়োগ, সামরিক ব্যয় বাড়াচ্ছে ভারত
ভারত এখন ড্রোন প্রযুক্তিতে বিপুল বিনিয়োগ করছে। ‘ড্রোন ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া’র প্রধান স্মিত শাহ জানান, আগামী এক-দুই বছরে ভারত প্রায় ৪৭০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে পারে, যা পূর্বের তুলনায় তিন গুণ বেশি। জরুরি প্রতিরক্ষা ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ দেওয়া ৪.৬ বিলিয়ন ডলারের বড় একটি অংশই যাচ্ছে ড্রোন সংগ্রহে।
ভারতের শীর্ষ ড্রোন কোম্পানি ‘আইডিয়াফোর্জ’-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট বিশাল সাক্সেনা বলেন, “প্রতিদিনই আমাদের ডাকা হচ্ছে ট্রায়াল দেখানোর জন্য। প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা এখন ড্রোনকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন।”
পাকিস্তান তাকিয়ে আছে চীন ও তুরস্কের দিকে
অন্যদিকে পাকিস্তান উচ্চমূল্যের যুদ্ধবিমান নয়, সস্তা ও কার্যকর ড্রোন ব্যবহারে মনোযোগী হয়েছে। তারা চীন ও তুরস্কের সঙ্গে যৌথভাবে ড্রোন তৈরি করছে। তুর্কি কোম্পানি বায়কার ও পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যারোস্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পার্ক মিলে তৈরি করছে অত্যাধুনিক ‘ওয়াইআইএইচএ-থ্রি’ ড্রোন, যা মাত্র ২-৩ দিনেই প্রস্তুত করা সম্ভব।
ড্রোন যুদ্ধের সূচনা: ৩০০-৪০০ ড্রোন আক্রমণ ও প্রতিরোধ
২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পুলওয়ামায় হামলায় নিহত হন ২৬ জন ভারতীয় পর্যটক। ভারত দায় দেয় পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গিদের ওপর এবং ৭ মে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালায়। পাল্টা জবাবে পাকিস্তান ৩০০-৪০০ ড্রোন পাঠায় ১,৭০০ কিমি সীমান্তজুড়ে।
ভারত ড্রোন প্রতিহত করতে ইসরায়েলের হ্যারপ, পোল্যান্ডের ওয়ারমেট এবং নিজস্ব প্রযুক্তির ড্রোন ব্যবহার করে পাল্টা হামলা চালায়। পাকিস্তানও চালায় জবাব—‘ফেক রাডার’ ও কৌশলী অপেক্ষার মাধ্যমে ভারতের ড্রোনগুলো গুলি করে ফেলে।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি: এই প্রতিযোগিতা সরাসরি যুদ্ধ নয়, কৌশলগত বার্তা
কিংস কলেজ লন্ডনের বিশ্লেষক ওয়াল্টার লাডউইগ বলেন, “ড্রোন সামরিক চাপ তৈরি করতে পারে, আবার যুদ্ধ ছাড়াও বার্তা পৌঁছে দিতে পারে।”
মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, “ড্রোনের খরচ কম, কিন্তু প্রভাব বিশাল।”
তবে ভারতের একটি বড় দুর্বলতা হলো—চীনা যন্ত্রাংশের ওপর নির্ভরতা। লিথিয়াম ব্যাটারি ও চুম্বক এখনও চীন থেকে আমদানি করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়েছে—সরবরাহ ব্যবস্থাও হতে পারে একেকটি অস্ত্র।
সরাসরি যুদ্ধ নয়, কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা নতুন সংকটে
যুদ্ধ এড়ানো গেলেও ড্রোন যুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন সামরিক ভারসাম্য গড়ছে। ভারত-পাকিস্তানের এই প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা শুধু দুই দেশের সামরিক নীতিকেই নাড়িয়ে দিচ্ছে না, বরং গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তাকেই নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!