রাজশাহী আর আম—এ যেন যুগ যুগ ধরে একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শুধু স্বাদে নয়, ঐতিহ্যেও রাজশাহীর আমের জায়গা আলাদা। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, রাজশাহীতে আম চাষের সূচনা হয়েছিল প্রায় ৫০০ বছর আগে। বাঘা উপজেলার ঐতিহাসিক শাহি মসজিদের টেরাকোটায় আমের মোটিফ আজও সে প্রমাণ বহন করে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতার বাজারে রাজশাহীর ফজলি ও ক্ষীরশাপাতি আম ছিল অভিজাত শ্রেণির প্রথম পছন্দ। ‘নাটোর ম্যাঙ্গো’ নামেই তখন পরিচিত ছিল এই অঞ্চলের আম। এমনকি লোককথায় পাওয়া যায়, বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের সময় লক্ষ্মণ সেন আয়েশ করে আম খেতে না পারায় আফসোস করেছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায়, হাজার বছর আগে থেকেই এই আম কতটা মূল্যবান ছিল।
রাজা-জমিদারদের হাত ধরে শুরু
রাজশাহীর বিভিন্ন জমিদার ও রাজারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উন্নত জাতের আম এনে বাগান করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় রাজশাহী শহরের রায়পাড়ায় গড়ে ওঠে দেশের সবচেয়ে বড় আমবাগান, যার আয়তন একসময় ছিল প্রায় ৫০০ বিঘা। সেখানে ছিল গোপালভোগ, কোহিতুর, হিমসাগর, ক্ষীরশাপাতি, রানীপছন্দসহ অসংখ্য উন্নত জাতের আমগাছ।

ঐতিহ্য হারালেও স্মৃতি এখনো বেঁচে আছে
১৯২৮-২৯ সালে রেলপথ নির্মাণ, এবং পরে সড়ক নির্মাণের সময় এই বাগানের শত শত গাছ কেটে ফেলা হয়। এরপর বসতি গড়ে ওঠায় অনেক ঐতিহাসিক বাগান হারিয়ে গেছে। তবে রায়পাড়া, বশুরী, হাড়ুপুর, কাঁঠালবাড়িয়া, কাশিয়াডাঙ্গা, হড়গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় এখনও কিছু ঐতিহ্যবাহী বাগান টিকে আছে।
বাঘা ও চারঘাটের আধিপত্য
রাজশাহীর বাঘা ও চারঘাট উপজেলার প্রতিটি গ্রামেই এখন আমবাগান রয়েছে। বাঘার হাজড়াপাড়া গ্রামের দেড় শ বছরের পুরোনো ২০০ বিঘার বাগান, চারঘাটের মাড়িয়া ও মোহননগরের বিশাল বাগানগুলো এখনো আম চাষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
নতুন উদ্যোগেও ঐতিহ্যের ধারা
তানোর, গোদাগাড়ী, দুর্গাপুর ও পুঠিয়া উপজেলাতেও গড়ে উঠেছে শত শত আমবাগান। এসব নতুন বাগানে দেশি-বিদেশি উন্নত জাতের আমের চারা লাগানো হয়েছে। নাটোর জেলার ছাতনী গ্রামের শতবর্ষী বাগানটিও রাজশাহীর ঐতিহ্যের অংশ হিসেবেই স্বীকৃত।
গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী জানান, “রাজা-জমিদারদের হাত ধরে নাটোর ও রাজশাহীতে আমের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আজ বিশ্বজুড়ে রাজশাহীর আমের পরিচিতি এনে দিয়েছে।”
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!