ফিতনা থেকে বাঁচার মূল উপায় দৃঢ় ঈমান: কোরআন-হাদিসের স্পষ্ট দিকনির্দেশনা
বর্তমান সময়কে অনেক আলেম ‘ফিতনার যুগ’ বলে আখ্যায়িত করেন। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া, নৈতিক স্খলন, অপসংস্কৃতি ও ভুল মতবাদের বিস্তারে মানুষের ঈমান আজ নানা পরীক্ষার মুখোমুখি। ইসলামি শিক্ষায় বলা হয়েছে—শক্ত ও সুসংহত ঈমানই ফিতনা থেকে নিরাপত্তার প্রধান উপায়।
আধুনিক সময়ে ফিতনা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে অনেকের কাছে সত্য ও মিথ্যার ভেদরেখা আর স্পষ্ট নয়। মানুষের বিশ্বাস, নৈতিকতা, পরিবার, সমাজ ও ধর্মীয় পরিচয় পর্যন্ত বিভিন্ন বিভ্রান্তি ও অপসংস্কৃতির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত। ফিতনার সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো—এটি নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে; কখনো শয়তানের কুমন্ত্রণায়, কখনো দুনিয়ার চাকচিক্যে, কখনো পরিবেশ বা মন্দ সঙ্গের কারণে।
অনেক সময় মানুষ ফিতনার ক্ষতি টেরও পায় না, কিন্তু এর প্রভাব হয়ে ওঠে গভীর। এ পরিস্থিতিতে একজন মুমিনের শক্তি হলো দৃঢ় ও পরিপক্ব ঈমান—যা পথ দেখায়, সুরক্ষা দেয় এবং শয়তানের আক্রমণ প্রতিহত করে। কোরআন-হাদিস স্পষ্টভাবে জানায়, ফিতনা থেকে বাঁচার প্রথম ও প্রধান শক্তি হলো ঈমানকে মজবুত করা।
ফিতনার যুগে ঈমানের গুরুত্ব
আল্লাহ তাআলা বলেন:
أَنَّ اللَّهَ يَحُولُ بَيْنَ الْمَرْءِ وَقَلْبِهِ
“আল্লাহ মানুষ ও তার হৃদয়ের মাঝখানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।” (সুরা আনফাল: ২৪)
এই আয়াত প্রমাণ করে—ঈমান টিকিয়ে রাখা আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়। তাই ফিতনা মোকাবিলায় প্রথম প্রয়োজন ঈমানের শক্তি।
ফিতনা ধ্বংসাত্মক—রক্ষা দৃঢ় ঈমান
আল্লাহ আরও বলেন:
وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً
“তোমরা সেই ফিতনাকে ভয় করো, যা সংঘটিত হলে শুধু জালিমদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।” (সুরা আনফাল: ২৫)
ফিতনার আগ্রাসন শুধু পাপীকে নয়; পুরো সমাজকে গ্রাস করে। তাই ঈমানই একমাত্র নিরাপত্তা।
দৃঢ় ঈমানই মানুষকে সঠিক পথে স্থির রাখে
আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا آمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ
“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি দৃঢ়ভাবে ঈমান রাখো।” (সুরা নিসা: ১৩৬)
অর্থাৎ ঈমান শক্ত করা একটি চলমান প্রক্রিয়া। ঈমান যত দৃঢ় হবে, ফিতনার আঘাত তত দুর্বল হবে।
ফিতনার আগমন—রাসুল ﷺ–এর সতর্কবাণী
রাসুল ﷺ বলেন:
سَتَكُونُ فِتَنٌ، الْقَاعِدُ فِيهَا خَيْرٌ مِنَ الْقَائِمِ
“ফিতনা দেখা দেবে; তখন বসা ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির চেয়ে উত্তম হবে।” (সহিহ বুখারি: ৩৬০১)
অর্থাৎ ফিতনার সময় হঠাৎ প্রতিক্রিয়া নয়; বরং দৃঢ় ঈমান ও ধীরস্থির সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
দুর্বল ঈমানের হৃদয় ফিতনার শিকার হয়
রাসুল ﷺ বলেন:
تُعْرَضُ الْفِتَنُ عَلَى الْقُلُوبِ عَرْضًا عَرْضًا
“ফিতনা একের পর এক মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে; যে গ্রহণ করে, তার হৃদয়ে কালো দাগ পড়ে।” (সহিহ মুসলিম: ১৪৪)
ফিতনা থেকে রক্ষার দোয়া
রাসুল ﷺ দোয়া করতেন:
يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ
“হে অন্তর পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনে স্থির রাখো।” (তিরমিজি: ২১৪০)
এ দোয়া প্রমাণ করে—ফিতনার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো দৃঢ় ঈমান।
ফিতনা থেকে বাঁচতে ঈমান দৃঢ় করার উপায়
১. আল্লাহর জিকির বেশি করা
أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
“আল্লাহর জিকিরেই হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে।” (সুরা রাদ: ২৮)
২. নিয়মিত কোরআন তিলাওয়াত ও বুঝে পড়া
রাসুল ﷺ বলেন:
إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ هُوَ حَبْلُ اللَّهِ
“নিশ্চয় এই কোরআন আল্লাহর দড়ি।” (তিরমিজি: ২৯০৬)
৩. সালাত প্রতিষ্ঠা করা
إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ
“নামাজ অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।” (সুরা আনকাবুত: ৪৫)
৪. আকিদা ঠিক করা
ফিতনা থেকে মুক্তির উপায় জিজ্ঞেস করলে রাসুল ﷺ বলেছিলেন:
كِتَابُ اللَّهِ — “আল্লাহর কিতাব।” (তিরমিজি: ২৯০৬)
৫. ভালো সঙ্গ গ্রহণ করা
الْمَرْءُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ
“মানুষ তার বন্ধুর দ্বীনের ওপর থাকে।” (তিরমিজি: ২৩৭৮)
৬. অভ্যন্তরীণ ফিতনা—হাসাদ, রাগ, গীবত থেকে দূরে থাকা
এসব গুণ ঈমানকে দুর্বল করে; রাসুল ﷺ এগুলো কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।
উপসংহার
ফিতনার যুগে বাহ্যিক কত ব্যবস্থা নিলেও প্রকৃত সুরক্ষা একটাই—শক্ত, সুসংহত ও পরিশুদ্ধ ঈমান। দৃঢ় ঈমান সেই আলো, যা অন্ধকার ফিতনার মাঝেও পথ দেখায়; শয়তানের প্রতারণা প্রতিহত করে; মানুষকে আল্লাহর দিকে স্থির রাখে।
লগইন
আধুনিক ফিতনার যুগে মুমিনের করণীয় | ছবি সংগ্রহীত
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!